পাসপোর্ট ইস্যুতে পুলিশ ভেরিফিকেশন তুলে দেয়ার পর যেন স্বস্তি ফিরেছে সেবাপ্রত্যাশীদের মাঝে। সেই সাথে পাসপোর্ট অফিসেও ফিরেছে শৃঙ্খলা। আগেরমতো দালালের বিরম্বনা এখন আর নেই। ভোগান্তি ছাড়াই নিজের কাজ নিজে করতে পারছেন সেবাপ্রার্থীরা। আপাতত বন্ধ হয়েছে ঘুষ বাণিজ্য, ফলে কমেছে তদবীর।চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিস ও আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস পাঁচলাইশ এ সরেজমিনে গিয়ে একাধিক সেবাপ্রার্থীর সাথে কথা বলে এসব তথ্য মিলেছে। আর প্রিন্টিং সমস্যার অযুহাতে সময়ক্ষেপণ থেকে মুক্তি পেয়েছে পাসপোর্ট প্রত্যাশীরা।
কোন ভোগান্তি ছাড়াই ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সুপার এক্সেপ্রেস পাসপোর্ট ডেলিভারি দেয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক মো. সাইদুল ইসলাম। অন্যদিকে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস পাঁচলাইশ এর উপ-পরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন বাহিরের কিছু দালালরা আমার দায়িত্বরত অফিসে দালালির সুযোগ করতে না পেরে জমা কাউন্টারে বিভিন্ন ভাবে হেনস্তার শিকার করে। তিনি আরো বলেন বেশ কিছুদিন আগে আমার অফিসের (উচ্চমান সহকারী মিজানুর রহমান) জমা কাউন্টারে একজন আবেদন কারীর ফরম সন্দেহ মনে হলে তাকে জিজ্ঞেস করলে দালালের মাধ্যমে করছে বলে শিকার করে, তখন অফিসার বলে তাকে নিয়ে আসতে আবেদনকারী ঐ দালালের সাথে অফিসের মটোফনে কথা বলিয়েদেন অফিসার থাকে বলেন আপনি সরকারি ফি ছাড়া বেশি টাকা নিয়েছেন কেন তখন জবাবে বলে আমার ইচ্ছা আপনি জমা করেন তা নাহলে আপনাকে ভিডিও করে ফেইসবুক এ দিব তখন টের পাবেন। আমার অফিসার আমাকে সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়টি আমাকে জানালে আমি একটি ব্যবস্থা গ্রহন করি। ঐ আবেদনকরীকে বলি আপনি বাকী টাকা দালাল থেকে ফেরত নিবেন এবং আরো জানতে চাই আমার অফিসের কেউ আপনার থেকে টাকা দাবী করেছে নাকি? আবেদনকারী বলেন না আপনার অফিসের কেউ টাকা নেইনি। আমার অফিসারের কোন অভিযোগ না পাওয়া সত্যেও ১০২ কাউন্টার থেকে সরিয়ে দিয়েছি, তিনি আরো বলেন আইন শৃঙ্খলা বাহিনী এই বিষয় কঠোর নজর দিলে ভালো হয়।
সুপার এক্সপ্রেস পাসপোর্ট জমা হচ্ছে দুই অফিসে এক্ষেত্রে গ্রহণ করতে হচ্ছে ঢাকা থেকে। আর এক্সেপ্রেস ক্যাটাগরির পাসপোর্ট ডেলিভারি দিচ্ছে ৮ দিনের মধ্যে।
সরেজমিনে মুনসুরাবাদের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে দেখা যায়, সুশৃঙ্খল পরিবেশ। সবাই যে যার মতো লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের কাজ সাড়ছেন। ফাইল জমা থেকে শুরু করে ফিঙ্গার প্রিন্ট ও পাসপোর্ট ডেলিভারিতেও লাইন। লাইনের বাইরে কেউ গেলেও সেবা না পাওয়ায় এখন আর কেউ লাইন ভাঙ্গেন না। তাই বিশৃঙ্খলাও নেই। তবে কেউ অসুস্থ বা শারীরিক সমস্যা থাকলে পরিচালকের বিশেষ সুপারিশে তিনি লাইন ছাড়া সেবা পেয়ে থাকেন।
সোপ্রার্থীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, একসময় ঘুষ আর হয়রানির অপর নাম ছিল পাসপোর্ট অফিস। দালালের মাধ্যমে নির্ধারিত পরিমাণের ঘুষ আদায় করা হতো। যেখানে ঘুষ না দিলে কোন কাজই হতো না। বর্তমানে সেই জায়গা থেকে তাঁরা সরে এসেছে। এখন আর ঘুষ দিতে হচ্ছে না। আলমগীর নামের এক সেবাপ্রার্থী বলেন, লাইনে দাঁড়িয়ে নিজের কাজ নিজে করছি, কোন ঝামেলায় পড়িনি। আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের আবেদনকারী মো. হারুন নামের আরেকজন বলেন, আগে এখানে টাকা না দিলে হয়রানি করতো, দালালের দৌরাত্ম্য ছিল, পুলিশ ভেরিফিকেশনের নামে চুক্তির মাধ্যমে একদিকে যেমন অনৈতিক লেনদেন হতো অন্যদিকে ডেলিভারিতে দীর্ঘ সময় ক্ষেপণ হতো। এখন কেউ হয়রানিও করছেনা আবার অনৈতিক সুবিধাও চায় না।
এব্যপারে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট ও ভিসা অফিসের পরিচালক মো. সাইদুল ইসলাম বলেন, ’আমার অবস্থান সবসময় ঘুষ বা হয়রানির বিরুদ্ধে। কাঙ্খিত সেবা দেয়ার লক্ষ্যে আমরা সর্বদা সচেষ্ট। আমারা আমাদের অফিসকে দালালমুক্ত করেছি। সুশৃঙ্খলভাবে সবাই নিজেদের কাজ করছে। ফলে সেবা আগের তুলনায় অনেক সহজ হয়েছে। এখন আর কেউ কোন অভিযোগ করছে না। হয়রানির সুযোগ না থাকায় তেমন কেউ তদবীরও করছেনা। আগে বেশিরভাগ সময় পুলিশ ভেরিফিকেশন আসতে সময় লাগত। ফলে পাসপোর্ট তৈরি ও ডেলিভারি যথা সময়ে দেয়া সম্ভব হতোনা। এখন পুলিশ ভেরিফিকেশন শিথিল করায় এনআইডি অথবা জন্মসনদের ভিত্তিতে পাসপোর্ট ইস্যু করছি। পুলিশ ভেরিফিকেশনের সেই সময়টা নষ্ট হচ্ছে না। নির্ধারিত সময়ের আগেই পাসপোর্ট ডেলিভারি করতে পারছি। কেউ চাইলে সুপার এক্সপ্রেস ক্যাটাগরিতে আজকে জমা দিয়ে কালকের মধ্যেই ঢাকা থেকে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে পারছে। ৪৮ ঘন্টার মধ্যেই ডেলিভারি হচ্ছে। আর এক্সপ্রেস ক্যাটাগরিতে ১২ দিনের কথা থাকলেও ৮ দিনের মধ্যে আমরা ডেলিভারি দিচ্ছি।
প্রিন্টিং সমস্যার একটা অযুহাত ছিল আগে এখন আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ’এখন থেকে ১০ বছর আগে বৃহত্তর চট্টগ্রামে বছরে পাসপোর্ট ইস্যু হতো ৫০ থেকে ৬০ হাজার। এখন ২ অফিস মিলে বছরে প্রায় ২ লাখ ২০ হাজার পাসপোর্ট ইস্যু হয়। এরমধ্যে বিভাগীয় অফিসে ১ লাখ ২০ হাজার আর পাঁচলাইশ অফিসে ১ লাখের মতো। এখন প্রিন্টিং সমস্যার কথা শুনিনা। যথাসময়ের মধ্যেই বই পেয়ে যাচ্ছি। ফলে সেবাপ্রার্থীরাও সন্তুষ্ট। আশা করি সেবা আরো সহজতর হবে, তখন তদবির একদমই থাকবে না।
এইদিকে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের উপ-পরিচালক শরিফুল ইসলাম বলেন গত ১৮ ফেব্রুয়ারি পাসপোর্ট সেবা সহজীকরণের লক্ষ্যে একটি পরিপত্র জারি করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের বহিরাগমন ৪ শাখা। যেখানে বলা হয়েছে ”নতুন পাসপোর্টের আবেদনের ক্ষেত্রে অনলাইনে যাচাইকৃত জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যের ভিত্তিতে আবেদনকারীগণকে পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যতিরেকে পাসপোর্ট প্রদান করতে হবে। বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশী নাগরিক এবং অপ্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য পাসপোর্টের নতুন আবেদনের ক্ষেত্রে অনলাইনে যাচাইকৃত জন্ম নিবন্ধন সনদের তথ্যের ভিত্তিতে আবেদনকারীগণকে পুলিশ ভেরিফিকেশন ব্যতিরেকে পাসপোর্ট প্রদান করতে হবে, এবং পাসপোর্ট পুনঃইস্যুর ক্ষেত্রে বিদ্যমান পাসপোর্টের সাথে চাহিত মৌলিক তথ্যের (নিজ নাম, পিতা-মাতার নাম, জন্ম তারিখ, জন্ম স্থান) পরিবর্তন হলে জাতীয় পরিচয়পত্রে প্রদত্ত তথ্য দিয়ে পাসপোর্ট ইস্যু করা যাবে। এর আগে পাসপোর্ট ইস্যুতে পুলিশ ভেরিফিকেশনের প্রয়োজনীয়তা শিথিল করার ঘোষণা দিয়েছিলেন দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, শান্তিতে নোবেল জয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনুস।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় পাসপোর্ট অফিসের অধিক্ষেত্র:চট্টগ্রাম মহানগরীর পাহাড়তলী, আকবরশাহ, ডবলমুড়িং, সদরঘাট, বন্দর, ইপিজেড, পতেঙ্গা, হালিশহর, খুলশী ও বায়োজিদ বোস্তামী থানা এবং চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড, মিরশ্বরাই, জোরারগঞ্জ, রাউজান, হাটহাজারী, রাঙ্গুনিয়া, ফটিকছড়ি, সন্দ্বীপ ও ভুজপুর উপজেলা।
চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিসের (পাঁচলাইশ) অধিক্ষেত্র:চট্টগ্রাম মহানগরীর চান্দগাঁও, কর্ণফুলী, কোতোয়ালী, পাচলাইশ ও বাকলিয়া থানা এবং চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া, বোয়ালখালী, সাতকানিয়া, লোহাগাড়া, আনোয়ারা, বাঁশখালী ও চন্দনাইশ উপজেলা।